উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্য আসামে বিধানসভা নির্বাচন শুরু হতে চলেছে ৪ এপ্রিল থেকে। দুদফার ভোট গ্রহণ হবে ওই রাজ্যে। প্রথম দফায় উত্তর আসামের কিছু এলাকার সঙ্গেই ভোট নেওয়া হবে বাঙালী প্রধান বরাক উপত্যকাতেও।
বরাক আর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নামোনি আসাম অঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলমানরা জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ।
নির্বাচন এলেই এই বাংলাভাষী মুসলমান, এবং তার সঙ্গে বাঙালী হিন্দুদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা চোখে পড়ার মতো বেড়ে যায়।
বারে বারেই এই বিপুল বাংলাভাষী মানুষ ব্যবহৃত হতে থাকেন রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটি হিসাবে।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার যে অঞ্চলটা নামোনি অসম, সেখানে প্রায় ৫৫% মানুষ মুসলমান, আর তাঁরা মূলত বাংলাভাষী। যদিও অসমীয়া সমাজে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে খাতায় কলতে মাতৃভাষা বদল করে অসমীয়াকে নিজেদের ভাষা বলে তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন একটা সময়ে।
আগেও যখনই নামোনি অসমের গ্রাম বা ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকাগুলোতে এসেছি, তখনই দেখেছি বাংলাভাষী মুসলমান এবং বাংলাভাষী হিন্দুদেরও একটা অংশের মধ্যে একটা আতঙ্ক থাকে – যদি ‘ডি’ ভোটার, অর্থাৎ – ডাউটফুল বা সন্দেহজনক ভোটার করে দেয় বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী বলে!অথবা যদি বিদেশী চিহ্নিতকরণের ট্রাইব্যুনাল জেলে পাঠিয়ে দেয়! অথবা যদি কোনও সন্ত্রাসী হামলা হয় তাদের গ্রামে!
ভোটের হাওয়া বুঝতে ধুবরী জেলার রউয়ের পাড়, ধর্মশালা, হাঁসদহ – এই সব এলাকার কয়েকজন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলাম।
তাঁদের কাছে রাস্তা, স্বাস্থ্য, , শিক্ষা – এগুলো বড় সমস্যা। এঁদের প্রশ্ন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কী করেন তাহলে? কেন তাঁদের নজর থাকে না সাধারণ মানুষের এইসব সমস্যাগুলোর দিকে!
তবে অনুন্নয়ন, পিছিয়ে থাকা – এসব বিষয় ছেড়ে উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা বারে বারে বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে জিগির তুলে ভোটের বৈতরণী পার করার চেষ্টা করেছেন। পিছিয়ে থাকে নি জাতীয় দলগুলিও। বলছিলেন ধুবরী কলেজের অধ্যাপক ত্রিপথ চক্রবর্তী।
তাঁর কথায়, ”আসাম চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের যে কাট অফ ডেট, সেটা মেনে তো কোনও দলই বিদেশী বিতারণ করে নি। কংগ্রেস মুসলমান ভোট ব্যাঙ্ক ধরে রাখার জন্য করেছে সেটা সবসময়ে। অসম গণ পরিষদও তাই। আর এখন বি জে পি সেটার পাল্টা হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ক কাছে টানার জন্য এক্সপ্লয়েট করছে।”
আসামের বাংলা সাহিত্যিক ইমাদুদ্দিন বুলবুল অবশ্য দৃষ্টান্ত দিয়ে মনে করাচ্ছিলেন যে শুধু বাঙালী মুসলমানদের ওপরে নয়, আসামে বারে বারে হিন্দু বাঙালীদের ওপরেও আক্রমণ হয়েছে। আতঙ্কে থাকতে হয় তাঁদেরও।
ধর্মীয় বিভাজন যদি ভোট প্রচারের একটা অঙ্গ হয়ে থাকে, তাহলে আরেকটা দিক হয়ে ওঠে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের ইস্যু।
লোকসভা নির্বাচনের আগে আসামে এসে নরেন্দ্র মোদী বারে বারেই এই বিষয়টার উল্লেখ করেছেন।
উগ্র অসমীয়া জাতীয়বাদী শক্তিগুলি বলে থাকে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী আসামে ঢুকে পড়েছে। সেটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? জানতে চেয়েছিলাম ধুবরীর প্রাক্তন বি জে পি বিধায়ক, এখন দলের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকা ধ্রুব কুমার সেনের কাছে।
নি বলছেন, ”লক্ষ লক্ষ মানুষ বাংলাদেশ থেকে চলে আসছে, এটা একেবারেই ভুল কথা। চোখের সামনেই তো দেখি যে সীমান্ত পেরিয়ে মানুষ আসে ঠিকই, আবার ফিরেও যায় কাজ করে। খুব কম সংখ্যক মানুষই ওদেশ থেকে এসে স্থায়ী ভাবে থেকে যায়, তবে সেই সংখ্যাটা কখনই লাখ বা হাজার নয়। এগুলো সব ভোটের সময় বলা হয়, কিন্তু সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধান কেউ করতে চায় না,” বলছিলেন মি. সেন।
আসামের বাংলাভাষী মুসলমান আর হিন্দুদের স্বার্থরক্ষায় কয়েক দশক ধরে আন্দোলন করে চলা নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমিতির প্রধান উপদেষ্টা হাফিজ রশিদ চৌধুরী বলছিলেন, ”সাধারণ অসমীয়াদের মাথায় একটা আতঙ্ক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে যে বাঙালীদের না তাড়ালে নিজভূমে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন অসমীয়ারা। শুধু বাংলাভাষী মুসলমান নয়, বাংলাভাষী হিন্দুরাও একই রকমভাবে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটান আসামে।”
বাংলাভাষী মুসলমানদের ওপরে ক্রমাগত বিষোদগারের জবাব দিতে প্রখ্যাত আতর ব্যবসায়ী মৌলানা বদরুদ্দিন আজমলের নেতৃত্বে বছর দশেক আগে তৈরি হয় অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট বা ইউ ডি এফ।
মি. আজমল বলছিলেন, ”অসম গণ পরিষদ তো দশ বছর ক্ষমতায় ছিল। অবৈধ অভিবাসীদের কতজনকে চিহ্নিত করতে পেরেছে তারা? বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের ইস্যুটা ভোটের আগেই সুযোগ বুঝে তোলা হয় বারবার। তাতে ভোট পাওয়া যায় যে। এখন বি জে পি-ও সেই একই কায়দা নিয়েছে।”
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চার্বাক অবশ্য ব্যাখ্যা করছিলেন, ”বাংলাভাষী মুসলমানদের একটা ছাতার তলায় নিয়ে আসার যে প্রচেষ্টা বদরুদ্দিন আজমল করেছিলেন, সেটা অন্তত বরাক উপত্যকায় আর কাজ করছে না কংগ্রেসের সংসদ সদস্য আর দলের অন্যতম জাতীয় মুখপাত্র সুস্মিতা দেবের কথায়, অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়টা তো শুধু আসামের সমস্যা নয়, অন্য রাজ্যেও এই সমস্যা আছে। কিন্তু বি জে পি এটা নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছে।”
ধর্মীয় আর জাতিগত বিভাজন আসামের ভোট প্রচারের একটা প্রায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে থেকেছে সব সময়েই। ধুবরীর কালারহাট গ্রামের একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন বাসিন্দার সামনে ধর্মীয় বিভাজনের কথাটা তুলতে রীতিমতো তর্ক বেঁধে গিয়েছিল।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নামোনি আসামে যে উন্নয়ন বা অনুন্নয়নের প্রসঙ্গটা সাধারণ মানুষকে তুলে ধরতে দেখলাম, আসামের আরেকটা উপত্যকা – বরাক – যেখানে প্রায় সকলেই বাংলাভাষী, সেখানকার সাধারণ মানুষও ধর্মের কথা না বলে রাস্তা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এসবের কথাই বলছিলেন।
রাস্তাঘাটের দুরবস্থার কথা বলাটা স্বাভাবিকই। বরাক উপত্যকার কাছাড়, হাইলাকান্দি আর করিমগঞ্জ জেলা তিনটের সীমানা দিয়ে যাওয়ার সময়ে সেটা ভালই টের পেয়েছিলাম। ওটা যে একটা জাতীয় মহাসড়ক – সেটা না বলে দিলে বোঝা যেত না.. অনেক জায়গায় রাস্তাই নেই – শুধুই মাটি আর পাথর, আর বড় বড় গর্ত।
হাইলাকান্দি আর করিমগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের সাধারণ মানুষ আরও বলছিলেন যে হিন্দু আর মুসলমান মিলে মিশে তাঁরা খুব শান্তিতেই থাকেন।
করিমগঞ্জ জেলার দৈনিক নববার্তা প্রসঙ্গের সম্পাদক হবিবুর রহমান চৌধুরী অবশ্য বলছিলেন, যে বরাকে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, লড়াই করেছে, সেখানেও ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি শুরু হয়েছে ইদানীং।
তবে বি জে পি-র আসাম রাজ্য নেতৃত্বে একমাত্র মুসলমান মুখ আমিনুল ইসলাম লস্কর বলছিলেন যে তাঁরা ধর্মীয় ভেদাভেদ করেন না, তাঁদের লড়াই বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়, বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। তাঁরা যদি ক্ষমতায় আসতে পারেন, তাহলে ভারতীয় হিন্দু – মুসলমানরা নিরাপদেই থাকবেন।
অবৈধ অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেওয়ার ডাক দুবছর আগে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আসামে গিয়ে বারে বারেই দিয়েছিলেন মি. লস্করের নেতা নরেন্দ্র মোদী।
এবারেও ভোটের প্রচারে মি. মোদী গিয়েছিলেন বরাক উপত্যকার বেশ কয়েকটি জায়গায়।
মি. মোদী যখন বরাকের কাটাখাল চরকিআলাবন্দের মাঠে ভাষণ দিচ্ছিলেন, গত রবিবার, সেখান থেকে কিলোমিটার ত্রিশেক দূরে এক বাড়িতে শ্রাদ্ধ চলছিল বুলু শব্দকরের।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর, ৮৫ বছরের বুলু শব্দকর একজন ভারতীয়। তবুও ভিক্ষা করে দিন চালানো এই বৃদ্ধকে বাংলাদেশী বলে সন্দেহ হওয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। জেলেই তাঁর মৃত্যু হয় কয়েকদিন আগে – যে জেলগুলোতে বন্দী হয়ে রয়েছেন আরও বহু বাংলাভাষী মুসলমান, এবং হিন্দু – নিছক সন্দেহের বশে – যে তাঁরা অবৈধ অভিবাসী।
সুত্র, বিবিসি